theclickmagazine

সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন চট্টলার বীরকন্যা মুশতারী শফী!

নিজস্ব প্রতিবেদক:  চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলেন উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতি, শহীদজায়া, মুক্তিযোদ্ধা  মুশতারী শফী।

আজ ২০ ডিসেম্বর, সোমবার বিকেল চারটার দিকে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে লাইফসাপোর্টে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উদীচী চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক শীলা দাশগুপ্তা। তিনি জানান, শহীদজায়া মুশতারী শফী লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। আজ বিকেল চারটার দিকে তাঁর লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়।

একাত্তরের শহীদ জায়া ও শহীদ ভগিনী বেগম মুশতারী শফী। বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী লেখিকা বেগম মুশতারী শফী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য ত্যাগী-সাহসী-সংগ্রামী সংগঠকের নাম বেগম মুশতারী শফী। ঘর থেকে যুদ্ধক্ষেত্র, নারী নেতৃত্ব থেকে গণআন্দোলনের নেতৃত্ব, শিক্ষা থেকে সাহিত্য ক্ষেত্রের বিশাল বিস্তৃত পরিসরে ব্যাপ্ত তাঁর কর্মযজ্ঞ।

এনায়েতবাজারের ডাক্তার শফীর ‘মুশতারী লজ’ নামের বাড়িটি ছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূতিকাগার।’ এই বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা বেলাল মোহাম্মদ তার কতিপয় সহকর্মীসহ এ বাড়িতে থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম রণাঙ্গন চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবন থেকে প্রচার কাজ চালিয়েছিলেন ২৯ মার্চ পর্যন্ত।

প্রতিবেশী অবাঙালিদের অভিযোগ এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে ৭ই এপ্রিল ‘মুশতারী লজ’-এ পাক বাহিনী অপারেশন চালিয়ে ধরে নিয়ে যায় স্বামী ডাক্তার মোহাম্মদ শফী ও কলেজ পড়–য়া ভাই খন্দকার এহসানুল হক আনসারীকে। তখন তিনি সাত সন্তানের জননী। সাত সন্তানের কারণে সে সময় বেঁচে যান হায়েনাদের হাত থেকে। শিশু সন্তানদের কান্নার চিৎকার শুনে তাকে রেখে যায় পাকিস্তানি সেনারা।

৭টি শিশু সন্তান নিয়ে শরণার্থীদের মিছিলে পায়ে হেঁটে ভারতের আগরতলায় আশ্রয় গ্রহণ করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ফার্স্ট এইড ট্রেনিং নিয়ে হাসপাতালে আহত যোদ্ধাদের সেবা করা, মনোবল অটুট রাখার জন্য মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্প ও শরণার্থী শিবিরে উদ্দীপকমূলক বক্তৃতা দেয়া এবং মাস্টার রোল করে শরণার্থীদের মধ্যে রিলিফের গুঁড়ো দুধ বিতরণ ইত্যাদি কাজ করি। 

যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতার গর্ব বুকে নিয়ে ২০ জানুয়ারি মুশতারী শফী চট্টগ্রামে নিজ বাড়িতে ফেরেন। বিভীষিকাময় শংকা, শূন্যতা আর অনিশ্চয়তার অতল অন্ধকারের মধ্যে স্বামী আর ভাইকে ফিরে পাওয়ার আশা তখনকার মতো ত্যাগ করে বাচ্চাদের কাছে ফিরে এসে বাঁচার তাড়নায় মুশতারী শফীকে নতুন যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। এই যুদ্ধ জীবনেরই বর্ণনা বিধৃত হয়েছে তাঁর ‘স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন’ গ্রন্থটিতে।

 শৈশবের একেবারে সূচনায় মাতৃহারা শিশু মুশতারীর ভবিতব্যই ছিল জীবনযুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম। সেটা হয়তো তার সাহিত্য কৃতিত্বর প্রেরণা জুগিয়েছিল, স্বয়ম্বর আত্মপ্রত্যয়ী নারীত্বের জাগরণে উদ্যোগী ভূমিকা নেওয়ার। ষাট দশকের প্রথম দিকেই নারীর স্বাধিকার চেতনা ও আন্দোলনের সংগঠন হিসেবে মুশতারী শফী চট্টগ্রামে বান্ধবী সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৪ সালে শুরু করেন মাসিক বান্ধবী সাময়িকীর নিয়মিত প্রকাশনা। সব্যসাচী এই লেখিকা শুধু লড়াই চালিয়ে গেছেন তা কিন্তু নয়। তিনি অন্যদেরও হার না মানার প্রেরণার উৎস ছিলেন।

১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয়েছিল ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির চট্টগ্রাম জেলা শাখার আহবায়ক হন তিনি। তাঁর বলিষ্ঠ নেত্রীত্বে বিভিন্ন পেশাজীবী, সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠন ও ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি চট্টগ্রামের কার্যক্রম বেগবান হয়। শুধু রাজনৈতিক আন্দোলনেই তিনি সক্রিয় ছিলেন না তিনি ছিলেন কলম সৈনিকও। মাত্র ১১ বছর বয়সে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় মুকুলের মাহফিলে গল্প লেখার মধ্য দিয়ে তাঁর লেখক জীবনের সূচনা।

বেগম মুশতারী শফী সাহিত্যিক। তাঁর আছে নিজস্ব বর্ণনাভঙ্গি, ভাষারীতি এবং নিজস্ব বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া। তাঁর অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, অন্তর্র্দৃষ্টি ও চিন্তাশক্তির জন্য জীবন ভিন্ন অন্য কিছু বা আর কারও দ্বারস্থ হবার প্রয়োজন হয়নি। না উচ্চশিক্ষা, না ব্যাপক অধ্যয়ন। উপন্যাসে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মন্ত্র উজ্জীবিত করে আমাদের বাঙালিয়ানা সত্তাকে। তাঁর উপন্যাস জীবন্ত, জ্বলন্ত সময়ের হাত ধরে এগিয়ে যায়। প্রচুর গল্প লিখেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের গল্প, একুশের গল্প শিরোনামের গ্রন্থও আছে তাঁর। বেতারে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন।

মুশতারী শফীর জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি। জন্মস্থান মালদহ জেলার কালিয়াচক (ভারত) এ। বাবার বাড়ি গেরদা , ফরিদপুর-এ। খন্দকার নজমুল হক আনসারী অবিভক্ত ভারতবর্ষের পুলিশের ডি,এস,পি ছিলেন। মা আরেফা খাতুন।

পারিবারিক পরিচিতি ছিলো খ্যাতিসম্পন্ন। দাদা খন্দকার হেলাল উদ্দীন আনসারী সাব রেজিস্টার পদে চাকরি করতেন। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহে পরোক্ষ অংশ নিলে চাকরি চলে যায়। নানা খান বাহাদুর কাজী আজিজুল হক, অবিভক্ত ভারতবর্ষের এস পি ছিলেন এবং ১৯৩৩ সালে ফিঙ্গার প্রিন্ট আবিষ্কারক।

পিতার চাকরি সূত্রে যেতে হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। ৩ মাস বয়সে মা মারা যান আর ১০ বছর বয়সে বাবা। সে কারণে লেখাপড়া এগোয় নি বেশিদূর। পিতৃ বিয়োগের পর অনেকটা ছিন্নমূল জীবন শুরু তাঁর। ১৯৫৪ সালের ১৬ জানুয়ারি ডেন্টাল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শফীকে বিয়ে করে বসতি গড়েন নগরীর এনায়েতবাজার এলকার শফী লজ এ।

মুশতারী শফী’র গ্রন্থের সংখ্যা ২২ টি। এর মধ্যে আছে গল্পগ্রন্থ: ‘দুটি নারী একটি যুদ্ধ’, ‘শঙ্খচিলের কান্না’, ‘জীবনের রূপকথা’, ‘এমনও হয়’, ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’,‘একুশের গল্প’,‘বিপর্যস্ত জীবন’,। উপন্যাস, ‘একদিন এবং অনেকগুলো দিন’,‘বেলা অবেলা’, ‘অকাল বোধন’,। একাত্তরের স্মৃতিচারণ গ্রন্থ, ‘স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন’, ডেজস অফ মাই ব্লেডিং হার্ট’, অনুবাদ করেছেন এ, এস ম-ল। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গ্রন্থ, ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’, ‘চিঠিঃ জাহানারা ইমামকে’। ভ্রমণকাহিনি, ‘আমি সুদূরের’, ‘স্মৃতিতে অমলিন যাঁরা’। প্রবন্ধ গ্রন্থ,‘আমার প্রতিরোধের আগুন’,‘নারী বলো আমরাও মানুষ’। কিশোর গ্রন্থ,‘একগুচ্ছ গল্প তোমাদের জন্যে’,‘মুক্তার মুক্তি’ (শিশুতোষ নাটক)। বেতারে প্রচারিত নাটক ১৭টি । এর মধ্যে মৌলিক রচনাÑ৯টি, বিভিন্ন লেখকের গল্প উপন্যাসের বেতার নাট্যরূপ ৮টি।

মুশতারী শফী সভাপতি, উদীচী চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ শান্তি পরিষদ এবং ট্রাষ্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর চট্টগ্রাম। এর বাইরে তিনি উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, সচেতন নাগরিক কমিটি (টি আই বি), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট,বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র, অনোমা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, থ্যালাসেমিয়া সেবা কেন্দ্র বাংলাদেশ, রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মেলন পরিষদ চট্টগ্রাম, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগর, এবং তারুণ্যের উচ্ছাস-এ।

তিনি আজীবন সদস্য,মা ও শিশু হাসপাতাল, চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রোগী কল্যাণ সমিতি, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতি ও হাসপাতাল, চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল, থ্যালাসেমিয়া সেবা কেন্দ্র বাংলাদেশ।

কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি সম¥াননা,পদক ও পুরস্কার পেয়েছেন অগণিত। তারণধ্যে উল্লেখযোগ্য, বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশিপ-২০১৬, মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ, অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার-১৪২৪ বাংলা, মহান একুশে স্মারক সম্মাননা পদক-২০১৭ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ঢাকা কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধা সন্মাননা-২০১৫,স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ঢাকা কর্তৃক‘কীর্তিমতী হিতৈষী’ সন্মাননা-২০১৫, গ্রামীণ ফোন ও দৈনিক পূর্বকোণ প্রদত্ত‘ চট্টগ্রামের অহংকার’ পদক-২০১২, বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র, চট্টগ্রাম কর্তৃক ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ গ্রন্থের জন্য’ পদক, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ওয়ারিঅর অফ দ্য ইস্ট সম্মাননা স্মারক-২০১১, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও সেন্টার অব এশিয়ান থিয়েটার কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশীয় সাংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য ইবসেন পদক-২০০৯, ঢাকা। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কর্তৃক ‘জেলা প্রশাসন স্মারক’-২০১৪, বেগম রোকেয়া সম্মাননা-১৯৮৯ ঢাক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কর্তৃক সম্মাননা স্মারক-২০১১, বাংলাদেশ উদীচী চট্টগ্রাম-১৯৮২, বীরকন্যা প্রীতিলতা পদক ও সম্মাননা- ২০০৬।

 

জেইউএস/

Spread the love
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •