theclickmagazine

কোনো একদিন !

জালালউদ্দিন সাগর: বেজেই চলছে মোবাইলে দেওয়া ওয়েব রিংটোন। চোখ খোলার পর তৃতীয়বারের মতো বাজছে। পাড়ে আছড়ে পড়া সমূদ্রের ডেউয়ের মতো শব্দ রিংটোনে। এমনটা সাধারণত হয় না। এভাবে টানা কল কেউ খুব একটা করে না আমাকে। কিংবা করার প্রয়োজনও পড়ে না কারো। টানা রিংটোন শুনতে অভ্যস্ত নই বলেই বিরক্ত লাগছে খুব। অসম্ভব বিরক্ত।

নিশাচর মানুষ আমি। কি-প্যাডে হাতের কাজ শেষ করতে করতে মধ্যরাত হয় প্রতিদিনই। মধ্যরাত! মধ্যরাত বললে রাতের প্রতি অবিচার হবে হয়তো। বলতে পারেন ভোর হয়ে যায়। কাজ শেষে প্রতিদিনই ঘুমোতে যাই ভোরের প্রথম প্রহরে।

ঘড়ির কাঁটা যখন ১২টা ছুঁইছুঁই তখন ঘুম ভাংগে আমার। ভোরে দেখা স্বপ্নগুলোকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মধ্য আকাশ যখন উত্তপ্ত হয় ঠিক তখন চোখের পাতা খোলে। করোনাকালে ঘরবন্দি জীবনে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম প্রাত্যহিক এই রুটিনে।

আবারও বেজে উঠলো মোবাইল। পাড়ে আছড়ে পড়া সমূদ্রের ডেউয়ের শব্দ। একবার, দুইবার, তিনবার। আচ্ছা এতো সকালে কে ফোন করবে আমাকে? এতো জরুরি কেন? আজ কী কোনো অ্যাসাইনমেন্ট ছিলো?

শেষ রাতে হাতের কাজগুলো মেইল করেই তো ঘুমিয়ে ছিলাম। তবে, কার এতো দায়―সাতসকালে সাধের ঘুমে কাঁচি চালানোর?

বুকশেলফে রাখা ঘড়ির কাঁটা ৮টা ছুঁইছুঁই। এতো সকালে কে কল দেবে আমাকে ? কেনইবা দেবে ? কেউ কি অসুস্থ ? হাসপাতালে? নাকি ..?

আজকাল ঘুমোতে যাওয়ার আগে, ঘুম থেকে উঠেও শুধুই মৃত্যুর খবর। ফেসবুক ওয়াল স্ক্রল করতে ভয় হয় খুব। চারপাশে মৃত্যুর আগামবার্তা।

অনেকটা বিরুক্তি নিয়েই চার্জে দেওয়া মোবাইলটা হাতে নিতেই ধক করে উঠলো বুকটা। মিসড কল লিস্টে ‘ডিসি ইলিয়াস ভাই’।

মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসেবে যোগ দেয়ার পর পেশাগত কারণেই পরিচয় তাঁর সাথে। অসম্ভব রকম ‘মাইডিয়ার’ একজন মানুষ তিনি। খুব সহজেই কাছে টানতে পারেন দূরের মানুষগুলোকেও। মানুষের প্রতি মানবিক এই আচরণের জন্য পেশাগত সম্পর্কটা জড়িয়ে গেছে ব্যক্তিগত সম্পর্কে।

কল দিতে যাবো ঠিক এমন সময়ে স্ক্রিনে আবারও ইলিয়াস ভাই। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করলেন, কী ভাই, কই আপনি? কল ধরেন না কেন?

অতো সকালে ইলিয়াস ভাইয়ের ফোন আশা করিনি কখনো। এতো সকালে তিনি আমাকে এতবার কল দেবেন কেন! তাও করোনার এই মহামারির মতো ব্যস্ত সময়ে। উত্তর দেওয়ার আগেই আবারও ইলিয়াস ভাইয়ের কণ্ঠ-আমি আপনার বাসার নিচে। তাড়াতাড়ি নামেন-এই বলেই লাইন কেটে দিলেন তিনি।

আমার বাসায় ইলিয়াস ভাই এর আগে শুধু একবার এসেছিলেন। করোনাকালের দিন কয়েক আগে। অতো সকালে কী এমন জরুরি দরকার পড়লো আমার কাছে তাঁর?

অনেকটা অপ্রস্তুতভাবেই গায়ে টি-শার্টটা চাপিয়ে নামলাম নিচে। গেইটের বাইরে জেলা প্রশাসনের পরিচিত সেই কালো পাজেরো। গাড়ির সামনে যেতেই নামলেন তিনি। হাতে এক ঝুড়ি রজনীগন্ধা।

ইলিয়াস ভাইকে দেখে কোনোভাবেই মেলাতে পারছিলাম না হিসাব। নিজেকে নিজেই জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা আজকে কত তারিখ? এলোমেলো মনে হচ্ছিলো সব কিছু। বয়সের ছাপ বলে কথা।

সব কিছু যেন গরমিল লাগছিলো ঘুমঘুম চোখে। গত চার মাস যে মানুষটাকে মাস্ক ছাড়া দেখিনি সে মানুষটা আমার সামনে, তাও মাস্ক ছাড়া। গত চার মাস যে মানুষটার হাতে শুধু গ্লাভসই দেখেছি, সে মানুষটার হাতে গ্লাভস নেই আজ!

আমার দিকে রজনীগন্ধাগুলো বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, জন্মদিনের শুভেচ্ছা সাগর ভাই। শুভ জন্মদিন।

হাত বাড়িয়ে ফুলগুলো নিয়ে মৃদু হেসে বললাম, ধন্যবাদ। কিন্তু আপনার মুখে মাস্ক নাই কেন? এই অসময়ে মাস্ক ছাড়া বাসা থেকে বের হলেন কীভাবে?

ইলিয়াস ভাই আরও একটু এগিয়ে এসে আমাকে অপ্রস্তুত করেই জড়িয়ে ধরলেন বুকে। শক্ত করে চেপে ধরে বললেন, করোনামুক্ত বাংলাদেশে আপনাকে স্বাগত সাগর ভাই।

আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম শরীর কাঁপছে আমার; ভারী হয়ে আসছে গলা। এমন একটি সকাল কতদিন দেখা হয়নি আমাদের!

রজনীগন্ধার ঝুড়িটা দুই হাতে শক্ত করে ধরে অনেকটুকু শ্বাস বুকের ভেতরে টেনে নিয়ে বললাম, বেঁচে থাকার জন্য এমন ব্যাকুলতা এর আগে কখোনো টের পাইনি ইলিয়াস ভাই। আবারও ধন্যবাদ আপনাকে।জীবনের শ্রেষ্ঠ সকালটা উপহার দিলেন আমাকে।

আবারও বাজছে মোবাইলের রিংটোন। পাড়ে আছড়ে পড়া ডেউয়ের সেই শব্দ। একবার,দুই,তিন…।

পাশের রুম থেকে ডাকছে সোনিয়া। সাগর,এই সাগর, কলটা ধরো। সেই কখন থেকে বাজছে মোবাইলটা।

Spread the love
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •