theclickmagazine

সুব্রত বড়–য়া রনি অনেকগুলো ‘প্রথম’র কান্ডারি যিনি!

নুসরাত জাহান: একজন ভালো মানুষ, গুণী মানুষ সবসময় তাঁর আশেপাশে ভালো পরিবেশ চান। তাঁরাই সমাজের আর দশটা সাধারণ মানুষকে তৈরি করে দেন বিকাশের ক্ষেত্র, বলা যায় অনেকটা নিজের তাগিদেই। এভাবেই আমাদের সমাজের, আমাদের দেশের, সর্বোপরিভাবে ইতিহাসের অনেক ‘প্রথম’ যাত্রা করে কিছু বিশেষ গুণসম্পন্ন ভালো মানুষের হাত ধরে। তাঁরা নিজেদের বিলিয়ে এই প্রথম আলোটা জ্বালেন বলেই সমাজের বাকী মানুষ কিংবা ইতিহাস চলার পথ পায়। বলা যতটা সহজ, জীবনের কর্মযজ্ঞে এই প্রথমের গল্প লেখা বোধ করি ততটা সহজ নয়। এর পেছনে প্রয়োজন হয় বহুমাত্রিক প্রতিভার জ্বালানি।

চট্টগ্রাম শহরের এমন কিছু মানুষের নাম যদি বলতে চাই তবে সে সারিতে নিজগুণে উজ্জ্বল একটি নাম হবে; সুব্রত বড়–য়া রনি। পাঠকের কাছে নতুন করে তাঁকে চেনানোর কিছু নেই। একনামে চট্টগ্রামবাসী তাঁকে চিনলেও এক পরিচয়ে চেনে না মোটেও। এখানেই তাঁর জীবনের বহুমাত্রিক বিস্তৃতি।

সুব্রত বড়–য়া রনি একাধারে সঙ্গীতশিল্পী,চারুশিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী, নাট্যকর্মী এবং ডিজাইনার। অবশ্য তাঁর কথা বলতে গেলে সব ছাপিয়ে ওঠে বাংলাদেশের সেই কিংবদন্তি ব্যান্ড ‘সোলস’ এর কথা। যার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ড্রামার ছিলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের পর সবদিক থেকে ভেঙে পড়া যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশকে গড়ে তোলার কাজে যখন সবাই ব্যতিব্যস্ত, সেই সময় দেশের শিল্প, সংস্কৃতি, সঙ্গীত জগতে আবির্ভাব ঘটে ‘সোলস’এর। সেইসব গান আজও আমাদের কোনো এক বিকেলের বারান্দা বা রাতের জানালা দখল করে রাখে। আজও মোহিত করে সুরে।

পৈতৃক নিবাস রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় হলেও চট্টগ্রাম শহরেই তাঁর বেড়ে ওঠা। ছোট থেকেই গানের প্রতি টান ছিলো তাঁর। বাবা সুখেন্দু বিকাশ বড়ুয়া ভালো গাইতেন। তবে রনি ঝুঁকেছিলেন তবলার দিকে। কলেজিয়েট স্কুলে পড়ার সময় থেকেই স্কুলের হয়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে থাকেন তিনি।

সিরাজউদ্দৌলা রোডের প্রাচ্য সঙ্গীতে তবলা শিখতেন সে সময়। গানবাজনাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে তাঁর নিজস্ব বৃত্ত। বন্ধুদের নিয়েই গড়ে তোলেন প্রথম গানের দল ‘সুরেলা’। ১৯৭২ এর শুরুর দিকের কথা। সে সময় তাঁরা একুয়িস্টিক বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত দেশে তখনও যন্ত্র বা প্রযুক্তিগত এত উৎকর্ষ ঘটে নি। কাঁধে করে এমপ্লিফায়ার বয়ে নিয়েও অনেকবার গান গাইতে হয়েছে। তারুণ্যের উদ্দীপনায় তাঁর সেসব দিন আলোকিত করেছে বাংলা গানের সমৃদ্ধ ভা-ারকে।

১৯৭২ পর ব্যান্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে সোলস। ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’, ‘নিঃসঙ্গতা’, ‘ আজ দিন কাটুক গানে’সহ আরও নানা জনপ্রিয় গান উপহার দিতে থাকে বাংলাদেশের মানুষকে। কলেজিয়েট স্কুল থেকে পাস করে মহসিন কলেজ এবং তারপর রনি ভর্তি হন চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজে। এখন এটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইন্সটিটিউট নামে পরিচিত। গানের পাশাপাশি তখন সমানতালে চলছে তাঁর চিত্রকলার চর্চা। চারুকলায় ডিজাইন নিয়ে রনি গ্রাজুয়েশন শেষ করেন ১৯৭৯ সালে। এরপর অবশ্য কিছুদিন তিনি দেশের বাইরে ছিলেন।

নাট্যমঞ্চেও তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রয়েছে স্বগর্বে। অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ের সাথে কাজ করেছেন বিখ্যাত সব নাটকে। ‘আগুনপাখি’সহ আরও অনেক নাটকে পালন করেছেন শিল্প নির্দেশকের ভূমিকাও। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অনেক প্রথমের সাথে জড়িয়ে আছে সুব্রত বড়–য়া রনির নাম। রনি, আহমেদ নেওয়াজ, অনুপ সাহা,নকীব খান, তপন চৌধুরীসহ আরও অনেকে মিলে সে সময় শুরু করেন সৈকতচারী নামে একটি সংগঠন। চট্টগ্রাম চারুশিল্পী সংগঠন, সৈকতচারী এরকম আরও অনেক সংগঠনের অনেকে মিলে চট্টগ্রামে প্রথম পহেলা বৈশাখের আয়োজন করেন তাঁরা।

ডিসি পাহাড়ের নিচে অনুষ্ঠিত সেই প্রথম পহেলা বৈশাখের স্মৃতিচারণ করে তিনি বললেন,তখন সুযোগ-সুবিধা বা আড়ম্বর এখনকার মতো এত বিপুল পরিমাণে ছিলো না। তবে মানুষের আবেগ ছিলো অসাধারণ। পহেলা বৈশাখ নিয়ে মানুষের উৎসাহ উদ্দীপনার কমতি ছিলো না কোনো।

এর পরের গল্পে অবশ্য চলে আসবে এক পুরোদস্তুর ডিজাইনার এর কথা। চট্টগ্রামে ‘অ্যাড অ্যাট’ নামে অ্যাডভেটাইজিং কোম্পানি শুরু করেন সুব্রত বড়–য়া রনি ও তাঁর বন্ধু সাজেদুল আলম। চিত্রশিল্পের মননশীলতা এবং দক্ষতা নিয়ে গড়ে তোলেন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট জগতের সুবিশাল ক্ষেত্র। সে সময় ইভেন্টের কাজের এত বিস্তৃতি তৈরি হয়নি। নেই তেমন সহজলভ্য উপকরণ বা সুযোগ সুবিধাও। তবে সোলস এ ছিলেন বলে চট্টগ্রামে তখন তিনি একনামে পরিচিত। এই পরিচয় তাঁর কাজের ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে অনেক। ১৫ বছর স্বকীয়তা ও নিপুণতায় চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির পহেলা বৈশাখের আয়োজনের দেখভাল করেছেন তিনি। বাওয়া স্কুলের মাঠে বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায়ের উৎসবেরও একজন অন্যতম আয়োজক ছিলেন এ কীর্তিমান।

এ ছাড়াও বিজিএমইএ এর বিভিন্ন আয়োজন সহ ঢাকার শেরাটনে ইউনিলিভার,সিলেটে বার্জার পেইন্ট, কক্সবাজার,ইনানী সহ নানা জায়গায় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট বা ডেকোরেশন তাঁর শৈল্পিক স্পর্শে সমৃদ্ধ হয়েছে। সুব্রত বড়ুয়া রনি বর্তমানে বাংলাদেশ ডিজাইনারস ফোরামের একজন অন্যতম সদস্য। ইন্টেরিয়র, এক্সটেরিয়র, গ্রাফিক্স ডিজাইনসহ আরও নানা শাখায় রয়েছে তাঁর প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর।

শিল্প বা কাজ তাঁর কাছে মানুষের মনের দরজায় কড়া নাড়ার পথ। নিজের জন্য শুধু বাঁচা যায় না কখনও। তাই মানুষের কথা, মানুষের পছন্দ, জীবন বারবার উঠে এসেছে রনির চিন্তায়, কাজে, সৃষ্টিতে।

ছবিয়াল: আরাফাত রুপক

Spread the love
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •